News Hungama:
খবর: কুশল দাশগুপ্ত (শিলিগুড়ি)
গবেষণায় মিলল বিপদের সংকেত। কাজ করছে না কোনও ধরনের কীটনাশক। উত্তরের আট জেলায় বিভিন্ন প্রজাতির মশাদের প্রতিরোধ ক্ষমতাও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। এর পাশাপাশি লোকালয়ে বাড়ছে এশিয়ান টাইগার মসকুইটো-র সংখ্যা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে যেখানে-সেখানে যথেচ্ছ কীটনাশক, মশা মারার তেল স্প্রে করায় মশাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা ক্রমেই বাড়ছে। যা নিয়ে চিকিৎসকদের পাশাপাশি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন গবেষকরাও।
মশা মারতে কোন কীটনাশক কত পরিমাণ ব্যবহার করতে হবে তা কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য দপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন ন্যাশনাল ভেক্টরবর্ন ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম থেকেই ঠিক করা হয়। সেই প্যারামিটার মেনেই কাজ করে পুরসভা, গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে সমস্ত সংস্থা। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, তালিকায় থাকা সমস্ত কীটনাশক নির্দিষ্ট পরিমাণে ব্যবহার করেও ডেঙ্গির জন্য দায়ী এডিস মশার প্রজাতিগুলিকে মারা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে উত্তরবঙ্গে ডেঙ্গি প্রতিরোধে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে প্রশাসন।
এই সংকট থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে ফাইটার কেমিক্যাল তৈরিতে গবেষণাগারে দিনরাত কাজ করছেন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ধীরাজ সাহা সহ সাত গবেষক। বেশ কয়েক বছর ধরে এডিস সহ বিভিন্ন প্রজাতির মশা নিয়ে কাজ করছেন ধীরাজবাবুরা। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন অংশ থেকে নমুনা সংগ্রহ করেছেন তাঁরা। তাঁদের গবেষণা বলছে, মূলত ২০১৯ সাল থেকেই উত্তরের জেলাগুলিতে এডিস মশা নিধনে ব্যর্থ হচ্ছে কীটনাশকগুলি। কোন এলাকায় কোন কীটনাশক কেন কাজ করছে না, সেক্ষেত্রে বিকল্প কী পদক্ষেপ করতে হবে, এইসব বিষয়ে নিয়মিত নজরদারি প্রয়োজন। তার জন্য এলাকভিত্তিক ম্যাপিং দরকার। ম্যাপিং ও নজরদারির অভাবেই ডেঙ্গির বাড়বাড়ন্ত হচ্ছে বলেই অভিমত গবেষকদের।
গবেষণার তথ্য বলছে, উত্তরের আবহাওয়া, জলবায়ু ও ভৌগোলিক অবস্থানের নিরিখে এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সক্রিয় থাকে এডিস প্রজাতির মশা। গবেষক প্রাপ্তি দাসের বক্তব্য, মশাকে পুরোপুরি বিলুপ্ত করা সম্ভব নয়। মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ম্যাপিং ও আগাম নজরদারি চালালে নির্দিষ্ট সময় পরিকল্পনামাফিক পদক্ষেপ করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। আর এক গবেষক শুভজিৎ দাসের ব্যাখ্যা, মশা মারার জন্য ঘর, গৃহস্থালিতে বহুজাতিক সংস্থার বিভিন্ন ধরনের যেসব তেল, ধূপ বা অন্য দ্রব্য দেদার ব্যবহার করা হয় তার ফলেও মশাদের মধ্যে মারাত্মকভাবে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হচ্ছে। মশাদের শরীরে জিনগত পরিবর্তন ঘটছে। ফলে কীটনাশক কাজ করছে না। উত্তরবঙ্গে মূলত ডেঙ্গি ছড়াত এডিস ইজিপ্টাই প্রজাতির মশা থেকেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণীবিদ্যা বিভাগের সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, জঙ্গলই যাদের মূল বাসস্থান ছিল সেই এশিয়ান টাইগার মসকুইটো বা এডিস অ্যালবোপিকটাস প্রজাতির মশার সংখ্যা ক্রমেই উত্তরবঙ্গের জনবহুল এলাকাগুলিতে বাড়ছে। শুধু তাই নয়, এশিয়ান টাইগার মসকুইটো জনবহুল এলাকায় বসবাসের জন্য নিজেদের জিনগত পরিবর্তনও ঘটিয়ে ফেলেছে। যার ফলে ডেঙ্গি ছড়ানোর জন্য এডিসের দুই প্রজাতি সমানতালে আক্রমণ করছে, যা বিপদ আরও বাড়িয়ে তুলেছে বলেই গবেষকদের মত।
আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকেও আলো ফেলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। তাঁরা জানিয়েছেন, স্থির ও স্বচ্ছ সামান্য জল পেলে সেখানেই ডিম পাড়ে ডেঙ্গির মশা। সেক্ষেত্রে বাড়ির টব, টায়ার, অন্য কোনও পাত্রে জমা জল আছে কি না সেদিকে কড়া নজরদারি প্রয়োজন। অথচ ডেঙ্গি নিয়ন্ত্রণে নর্দমা সহ যেসব স্থানে স্প্রে করা হচ্ছে সেখানে এডিস মশা কার্যত বসবাসই করে না। যাঁরা স্প্রে করছেন তাঁদের মশার প্রজাতি, জীবনযাত্রা সম্পর্কে সেভাবে কোনও ধারণাই নেই। ফলে এডিস বাদে কিউলেক্স সহ অন্য প্রজাতির মশাদের কীটনাশক প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ছে। অযথাই বহু উপকারী পতঙ্গ মারা যাচ্ছে। ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। অর্থাৎ লোক দেখাতে জনপ্রতিনিধিরা যেভাবে কীটনাশকের অপব্যবহার করছেন তাতে মানুষের উপকারের চাইতে ক্ষতিই বেশি হচ্ছে। গবেষক মানসপ্রতিম মোদকের বক্তব্য, কীটনাশক ব্যবহারে যত বেশি আমরা বিজ্ঞানকে অবহেলা করব ততই বিপদের দিকে এগিয়ে যাব। কেন্দ্রীয় সরকারের একটি প্রকল্পে আমরা উত্তরবঙ্গের ম্যাপিংয়ের কাজ করছি। সেটা মশা নিয়ন্ত্রণে কাজে লাগবে।
ফাইটার কেমিক্যাল তৈরির কাজ তদারকি করছেন গবেষক অভিষেক সুব্বা। তাঁর কথায়, কাজ অনেকটাই এগিয়েছে। দ্রুত নতুন দিশা দেখানো যাবে বলেই আশাবাদী। ধীরাজের বক্তব্য, পূর্ণাঙ্গ মশা নিধনের চাইতে মশার জন্ম নিয়ন্ত্রণ করাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যে দিকটায় আমরা সেভাবে নজর দিচ্ছি না। তবে যেভাবে উত্তরবঙ্গের এলাকাগুলিতে কীটনাশক ব্যর্থ হচ্ছে সেটা সত্যিই চিন্তার। নর্দমায় কীটনাশক ছড়িয়ে ডেঙ্গি নিয়ন্ত্রণ বাস্তবে সম্ভব নয়। বিজ্ঞানভিত্তিক কার্যপ্রণালী মেনে পদক্ষেপ জরুরি।তাহলেই হয়ত কিছুটা হলেও দমিয়ে রাখা যাবে মশাদের অগ্রাসনকে।